নারায়ণগঞ্জের বেদনাবিধুর বোমা হামলার ২৪ বছর আজ ১৬ জুন। ২০০১ সালের এই দিনে চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় ২০ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক লোক। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চন্দন শীল ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রতন দাসসহ আরও অনেকেই।
তবে বিগত ২৪ বছরেও এই বেদনাবিধুর বোমা হামলার বিচার হয়নি। নানা কারণেই এই মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত করা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েও এই হামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হয়নি। সবশেষ শামীম ওসমান সাক্ষ্য দিতে গিয়ে চার্জশিটের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে আদালত আগামী ১ আগস্ট মামলার রায়ের দিন ধার্য করেছেন। আর এই রায়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে বলে মনে করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
চাষাড়া বোমা হামলার ঘটনায় খোকন সাহা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় দুটি মামলায় (একটি বিস্ফোরক অন্যটি হত্যা) জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তৈমুর আলম খন্দকারকে প্রধান করে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের মোট ২৭ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার ২২ মাস পর ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে মামলা দুটির ফাইনাল রিপোর্টে মেলে অবাক করা তথ্য।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লিখিত ২৭ জনের কেউই চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়। যদি ভবিষ্যতে অত্র মামলার তথ্য সম্বলিত ক্লু পাওয়া যায় তাহলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঘটনায় নিহত চা দোকানি হালিমা বেগমের ছেলে আবুল কালাম বাদী হয়ে শামীম ওসমান, তার ভাই নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমানসহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এর সহযোগী সংগঠনের ৫৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি মামলা করেন। উচ্চ আদালত এ মামলাটি খারিজ করে দেন।
দীর্ঘ ছয় বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর সিআইডির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারকে আদেশ দেন। ২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলার ১২ বছর পর ছয়জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি দিয়ে দুটি মামলাতেই নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯৪৭ পাতার পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করা হয়। তবে উভয় মামলাতেই অভিযুক্ত ও অব্যাহতিপ্রাপ্তরা ছিল অভিন্ন।
চার্জশিটে অভিযুক্ত ছয়জন হলেন- নারায়ণগঞ্জে ক্রসফায়ারে নিহত যুবদল ক্যাডার মমিনউল্লাহ ডেভিডের ছোট ভাই শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, (এরইমধ্যে অপর এক মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত), জঙ্গি নেতা ওবায়দুল্লাহ রহমান, তার ভাই ভারতের দিল্লী কারাগারে আটক আনিসুল মোরসালিন, মুহিবুল মুত্তাকিন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু।
তবে সাক্ষ্য প্রদানের সময় নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনায় চার্জশিটভুক্ত আসামি মহানগর বিএনপির নেতা ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু, চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে জড়িত মনে করেন না ওই ঘটনায় আহত এমপি শামীম ওসমান।
ওই বোমা হামলায় যারা প্রাণ হারিয়ে ছিলেন —–
সেদিন নিহত হয়েছিলেন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সহোদর সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এ বি এম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক মহিলা।
হামলায় শামীম ওসমান সহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। তার ব্যক্তিগত সচিব চন্দন শীল, যুবলীগ কর্মী রতন দাস দুই পা হারিয়ে চিরতরে বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব।
আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত) অ্যাডভোকেট একেএম ওমর ফারুক নয়ন বলেন, মামলায় ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সাক্ষীদের মধ্যে মামলার বাদী অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ডাক্তারের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করা হয়নি। তারা মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়নি। যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই মামলার বিচার কার্যক্রম ঝুলেছিল। বর্তমান সরকারের সময় আদালত মামলাটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে। সেইসঙ্গে সমস্ত কার্যক্রম শেষে আদালত আগামী ১ আগস্ট রায়ের দিন ধার্য করেছে। যার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে।