গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। তারা প্রবীণদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সন্দিহান। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান থেকে সুরক্ষা চেয়ে বিশ্বের কাছে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের আবেদনের বিষয়টি নিয়েও উপহাস করছে পশ্চিম তীরের তরুণরা।
এই শহরের দেয়ালগুলো এখন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত তরুণদের ছবি দিয়ে ঢাকা, যাদের মধ্যে কেউ কেউ হামাসের সদস্য।
জেনিনে হাসপাতালের পরিচালক উইসাম বকর বলেন, জেনিনে ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ এবং তরুণদের হত্যা করা জনগণকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। প্রতিদিনই আমরা একজন করে বন্ধুকে হারাচ্ছি। তার মতে, এটি কখনোই শান্তি বয়ে আনবে না। বরং আরও প্রতিরোধের জন্ম দেবে।
গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রক হামাস ও সমমনা প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সদস্যরা গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে আচমকা হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন, অপহরণ করা হয় অন্তত ২৪০ জনকে। এরপর থেকেই গাজায় বর্বরোচিত হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এতে সাড়ে ১৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
৭ অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরেও সামরিক অভিযান বাড়িয়েছে ইসরায়েল। সেখানে ৬৯ শিশুসহ ২৭১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
এ অবস্থায় নাবলুস, জেনিনসহ পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ অংশে হামাসের মতো সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে সমর্থন বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ফাতাহ দলের (পশ্চিম তীরের ক্ষমতাসীন দল, যার প্যালেস্টাইনিয়ান অথোরিটি বা পিএ’র ওপর আধিপত্য রয়েছে) যুবনেতা রায়েদ ডেবি বলেন, আমি এটি লক্ষ্য করেছি- মানুষের কথায়, তাদের গাড়িতে বাজানো গানে, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে, আমার ছাত্রদের মধ্যে তর্কের সময়।
তিনি বলেন, ৭ অক্টোবরের হামলা ফিলিস্তিনিদের জন্য যেমন ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল, তেমনি ইসরায়েলিদের জন্য ছিল ‘শকিং পয়েন্ট’।
রায়েদ বলেন, জনসাধারণ, বিশেষত নতুন প্রজন্ম এখন হামাসকে সমর্থন করছে এবং তুলনামূলকভাবে এই সমর্থন আগের চেয়ে বেশি। গত ৩০ বছরে নতুন প্রজন্মের জন্য কোনো রোল মডেল ছিল না, কোনো আদর্শ ছিল না; এখন অন্তত অন্য ধরনের কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে তারা। একটি নতুন গল্পের সূচনা দেখছে তারা।
এমনকি রায়েদের ১১ বছরের ভাইপোও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রতি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নয়। বরং সে হামাসের সামরিক মুখপাত্র আবু উবাইদাকে আদর্শ বলে মনে করে, কারণ তিনি (আবু উবাইদা) তাদের রক্ষা করেন।
স্বাধীনতায় অগ্রাধিকারপশ্চিম তীরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আমজাদ বুশকার বলেন, ফিলিস্তিনি তরুণদের কিছু ইচ্ছা ছিল, সে সংক্রান্ত একটি তালিকাও ছিল। কিছু বিষয়কে তারা অগ্রাধিকার দিতো। বাড়ি কেনা বা ডিগ্রি অর্জনের মতো বিষয়গুলো ছিল সেই তালিকায়।
‘কিন্তু আমি মনে করি, ৭ অক্টোবরের পর যে বিষয়গুলোকে তারা অগ্রাধিকার দিতো, তা পুরোপুরি বদলে গেছে। প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আওয়াজ উঠছে- তা সে প্রতিরোধ শান্তিপূর্ণ হোক বা সশস্ত্র।
ড. বুশকার জানান, তিনি মোট নয় বছর ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছেন। অতীতে তিনি হামাসের ছাত্র শাখার সদস্যও ছিলেন। ৭ অক্টোবরের পর থেকে তার পরিবারের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শুধু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীই নয়, ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে হামাস সদস্যদের ধারাবাহিকভাবে নিশানা করেছে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীও। কিন্তু এখন কিছু পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন ড. বুশকার।
তার কথায়, ফাতাহ এবং হামাস দুপক্ষই ভালো করে জানে, তারা একে অপরের পরিপূরক। আর আমি মনে করি, এই দুই আন্দোলনকে সত্যিই এক হতে দেখবো আমরা।
তিনি বলেন, প্যালেস্টাইনিয়ান অথোরিটি বুঝতে পেরেছে, হামাসকে নিশানা করলেও একে নির্মূল করা যাবে না। কারণ এটি ফিলিস্তিনি জনগণের মনের গভীরে গেঁথে থাকা একটি মতাদর্শগত আন্দোলন। আর হামাসও এ বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন যে, তারা ফাতাহর সাহায্য ছাড়া একটি স্বাধীন (ফিলিস্তিনি) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।
মাহমুদ আব্বাসের জনপ্রিয়তায় ধসসাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বাদে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের একাধিক প্রবীণ ব্যক্তিত্ব প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ফ্রন্টের সুবিধার কথা আলোচনা করছেন।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শাতায়েহ বলেন, গাজায় যে যুদ্ধ চলছে তাতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পছন্দসই ফলাফল হবে যদি হামাস পিএ’র নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগ দেয়।
ফিলিস্তিনি থিংক ট্যাংক প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ (পিএসআর) গত ২২ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, তিন মাস আগের তুলনায় পশ্চিম তীরে হামাসের প্রতি সমর্থন তিনগুণ বেড়ছে।
হামাসের সমর্থকরা এখনো সংখ্যালঘু। তবে উত্তরদাতাদের ৭০ শতাংশ বলেছেন, যে সশস্ত্র সংগ্রামই হল ইসরায়েলি দখলদারি অবসানের সবচেয়ে ভালো উপায়।
অন্যদিকে, হামাসের হামলার পর প্রেসিডেন্ট আব্বাসের প্রতি সমর্থন দ্রুত কমেছে বলে ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম তীরের ৯০ শতাংশেরও বেশি ফিলিস্তিনি আব্বাসের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
সম্প্রতি গাজায় আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয় ফিলিস্তিনি বন্দিদের। সে সময় ফিলিস্তিনি নাগরিকে ঠাসা প্রতিটি বাসের আশপাশে হামাসের পতাকা ওড়ানো এবং স্লোগান দেওয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। যদিও সেখানে পিএ’র প্রতিনিধি বা নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা অনুপস্থিত ছিলেন।
অর্থাৎ, গাজায় হামাসের ক্ষমতার কথা ইসরায়েল হয়তো অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু পশ্চিম তীরেও গোষ্ঠীটির প্রভাব এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।